অচল ৩৩ বিদ্যুৎকেন্দ্র : প্রণোদনা ও তাগিদের পরও চালু হচ্ছে না
ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় :
০৫-১২-২০২৪ ০৯:১৮:২৮ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৫-১২-২০২৪ ০৯:১৮:২৮ অপরাহ্ন
জ্বালানিনির্ভর বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে আগামী জুলাই থেকে চালু করার তাগিদ দিয়েছে সরকার। এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে পারলে প্রণোদনা হিসেবে ১০ বছর পর্যন্ত শতভাগ কর অব্যাহতি পাওয়া যাবে। সরকারের এমন তাগিদ ও প্রণোদনা সত্ত্বেও উৎপাদনে যেতে পারছে না অন্তত ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় এসব কেন্দ্র চালু করা নিয়ে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকারের তাগিদ ও প্রণোদনাসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে (গত ২৭ নভেম্বর) বলা হয়, ২০২৩ সালের আয়কর আইনের ৭৬ (১) ধারার ক্ষমতাবলে যেসব ব্যক্তি ও কোম্পানির নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর প্রকল্প বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন ২০২৫ সালের ১ জলাই থেকে আরম্ভ হবে, সেসব প্রকল্প বা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন আরম্ভ হওয়ার ১৫ বছরের জন্য কর অব্যাহতি দেওয়া হলো। এর মধ্যে উৎপাদন আরম্ভ হওয়ার ১০ বছর পর্যন্ত শতভাগ, পরবর্তী ৩ বছরের জন্য ৫০ ভাগ এবং তার পরবর্তী ২ বছরের জন্য ২৫ ভাগ কর অব্যাহতি দেওয়া হলো। প্রজ্ঞাপনটি আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
পেট্রোবাংলাসহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দেশে বড় ও ছোট মিলিয়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ৭১টি। এর মধ্যে গ্যাসের অভাবে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে ৩৩টি। অন্যতম গ্যাস সরবরাহকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের আওতাধীন নারায়ণগঞ্জে জেরার-মেঘনাঘাট (আগের নাম রিলায়েন্স মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড) ৭১৮ মেগাওয়াট, ঘোড়াশালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, অ্যাগ্রিকো ১৪৫ মেগাওয়াট, সিদ্ধিরগঞ্জ ১২০ মেগাওয়াট, হরিপুরে ৫১২ মেগাওয়াট, সামিট-মেঘনাঘাট ৩৩৫ মেগাওয়াট, ডরিন পাওয়ারের টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে একই সক্ষমতার (৪৪ মেগাওয়াট) দুটি, হরিপুরে ৩৬০ মেগাওয়াট ও রিজেন্টের ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
দেশের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখলে প্রতিদিন গ্যাস প্রয়োজন ১২০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ প্রায় ৯২ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের এই অসামঞ্জস্য চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সহসাই এ সংকটের সমাধান মিলবে- এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না কেউ।
এ বিষয়ে তিতাসের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন বিভাগ) প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান বলেন, ‘পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) যে কোম্পানিকে যেভাবে গ্যাস বরাদ্দ দিয়েছে, সেই বরাদ্দপত্র অনুসারে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্ধারিত গ্যাস সরবরাহের বাইরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বাড়তি গ্যাস দেওয়ার সুযোগ তিতাসের নেই।’
এ অবস্থায় গ্যাসের জোগান নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধু রাষ্ট্র জাপানের বিনিয়োগ। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ করেছে জাপানভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি জাপানস এনার্জি ফর এ নিউ এরা (জেরা)। ২০১৯ সালের জাপানের এই কোম্পানি মেঘনাঘাট যৌথ জ্বালানি (কম্বাইন্ড সাইকেল) নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু করে। বাণিজ্যিক অপারেশন অর্জনের জন্য গত ২৬ অক্টোবর পরীক্ষামূলক উৎপাদনের কার্যক্রমও শেষ করে। কিন্তু তিতাস থেকে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না কেন্দ্রটি। এরই মধ্যে এ প্রকল্পে জেরা ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। প্রকল্পটির বিনিয়োগে জেরা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনসহ একাধিক জাপানিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটেই রয়েছে জ্বালানিনির্ভর তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। একই সময়ে গড়ে ওঠা সামিট ও ইউনিকের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ইতোমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। সব রকমের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এবং সরকারের তাগিদ সত্ত্বেও জাপানের বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখনো বাণিজ্যিক উৎপাদনে (সিওডি) যেতে পারেনি। কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে না পারায় জেরাকে গুনতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ঋণের কিস্তি। সম্প্রতি জেরার পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গ্যাস সরবরাহ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। চুক্তি থাকার পরেও গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছে না ওই কেন্দ্রটি।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে জেরার আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কাছ থেকে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কেন্দ্রটি ২২ বছর পিডিবিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।
এসব বিষয়ে জেরা মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের হেড অব কন্ট্রাক্টস অ্যান্ড কমার্শিয়াল স্মিতেশ বৈদ্য বলেন, ‘প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবে। আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রকল্পটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, এর অত্যন্ত কর্মদক্ষ টারবাইন রয়েছে এবং প্রতিযোগিতামূলক দামে বাংলাদেশের জাতীয় পাওয়ার গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা এর আছে। আমাদের বিশ্বাস, বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই কেন্দ্রটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।’
জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘জেরার বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবশ্যই গ্যাস দেওয়া উচিত। আর তা না হলে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নেচিবাচক প্রভাব পড়বে। এমন বার্তা যাবে, ফরেন ইনভেস্টমেন্টকে ঠিকমতো অপারেট করতে দেওয়া হচ্ছে না।’
সূত্র: খবরের কাগজ
বাংলাস্কুপ/ ডেস্ক/ এনআইএন/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স